
পিপলআইস রিপোর্ট: মিষ্টির ফেরিওয়ালা থেকে ভাতের হোটেল দেন আকবর আলী মিঞা। সেখান থেকেই জন্ম আজকের আকবরিয়ার। এরপর ১১০ বছরের পথচলায় দেশের জন্য গর্বের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। খাবারের মান, সেবা ও নতুন নতুন খাবার চালু করে যেমন দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি একইভাবে নিরন্ন, অসহায় মানুষকে খাবার দিয়ে, স্বাবলম্বী করেও সৃষ্টি করেছে উদাহরণ। ভালো মানের খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি জনসেবামূলক কাজ করে দেশের একটি অনুকরণীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বগুড়া জেলার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। রাত ১১টার পরে বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের নিউ মাকের্টের সামনে গেলেই দেখা যাবে অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশু প্রধান সড়কের দুই ধারে বসে রয়েছেন। অপেক্ষা করছেন খাবারের জন্য। দেখে হয়তো মনে হবে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এসব মানুষ খাবার খেতে এসেছে। আসলে এরা বগুড়া শহরের অসহায়, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক অভাবী মানুষ। প্রতিদিন গভীর রাতে এখানে বিনা মূল্যে অসহায়দের খাবার বিতরণ করেন বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। সেই খাবার খেতেই তারা গভীর রাতে বসে রয়েছেন। প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ মানুষ এই খাবার খেয়ে থাকে।
উত্তরের বগুড়া জেলা নানা কারণেই বিখ্যাত। কিন্তু ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানও তার কাজ ও সেবা দিয়ে একটি স্থানের, জেলার এমনকি দেশ জুড়ে সুনাম ছড়ায়। বগুড়ার আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট শত বছরের বেশি সময় ধরে মানুষের সেবা দিয়ে নিজেদের সেই উচ্চতায় তুলে এনেছে। চল্লিশ থেকে ষাটের দশকে ঘি দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানির দাম ছিল এক টাকা প্লেট। সেই সময়ে আকবর মিঞা তার হোটেলে ১৫ থেকে ২০ টাকার মধ্যে সারা মাস তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতেন। ব্রিটিশ আমলে শহরে বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন। সুলভ মূল্যে ভালো খাবার এবং এমনি নিত্যনতুন চমকে আকবরিয়ার নামডাক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ার সাদা চিকন সেমাইয়ের দেশব্যাপী যে কদর তার মূলেও ছিলেন আকবর আলী। উত্তরাঞ্চলে প্রথম লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে আকবরিয়া যার কদর দেশ ও দেশের বাইরেও।
সে সময় কলকাতা থেকে সেমাই আসত বাংলাদেশে। সেমাই তৈরির গল্প কারো জানা ছিল না। এই অঞ্চলের মুসলমান বা সাধারণ মানুষদের অল্প দামে সেমাই খাওয়ানোর তাগিদ থেকে তিনি সেমাই তৈরি করে সফল হন। হোটেল ব্যবসায় দিন দিন ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। ধর্মভীরু মানুষ আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি এবং প্রসারে সৃষ্টিকর্তার রহমত আছে এ কথা বিশ্বাস করতেন। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি আয়ের একটা অংশ দিয়ে প্রতিদিন রাতে গরিব, মুসাফির, ভিক্ষুক, মিসকিনদের খাওয়াতেন। তাদের খাওয়াতে গিয়ে তৎকালীন আয়কর বিভাগ তাকে আয়কর দিতে চাপ দিতে থাকে। একসময় নিজের একটা পুকুর ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি করে আয়কর পরিশোধ করেন। তার পরও তিনি ফকির-মিসকিনদের খাওয়ানো বন্ধ করেননি। তিনি সেটা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করে গেছেন। পরবর্তীকালে তার বংশধররা সেই ধারা চালু রেখেছেন। সেই সঙ্গে মানুষের সেবার পরিধির আরো বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন।
শহরের ফুটপাতের বৃদ্ধ ভিক্ষুক জাবেদ আলী জানান, সারা দিন ভিক্ষা করে যা পান তা দিয়ে তার দিন চলে আর রাতে তিনি আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে ঘুমান। রোজার সময় তিনি আকবরিয়া হোটেলের দেওয়া সেহরি খেয়ে রোজা রাখেন। তিনি জানান, আকবরিয়া হোটেলে ভালো মানের খাবার দেয়। ভাতের সঙ্গে মাছ, মাংস, সবজি, ডাল, আলুঘণ্ট, শাক ইত্যাদি থাকে খাবারের মেন্যুতে।
আকবর আলী মিঞার ছোট ছেলে ও আকবরিয়া লিমিটেড এর চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগে আকবর মিঞা পুত্রদের হোটেলের আয় থেকে মুসাফির, ভিক্ষুক, গরিবদের খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে যান। সে কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি আজও। পিতার শুরু করা নিয়ম মেনে তার ছেলে বা নাতিরা আজও তা পালন করে যাচ্ছেন। শতবছর ধরেই একবেলা বিনা মূল্যে এই খাবার তুলে দিয়ে যাচ্ছে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ১৯১১ সালে হোটেলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই হোটেলের আয় দিয়ে বাবাই প্রথম দিনহীন মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাবার সেই নিয়ম পালন করে যাওয়া হচ্ছে। মূলত খাবারটি বিতরণ শুরু হয়েছিল মুসাফিরদের জন্য। কালক্রমে মুসাফিরের জায়গায় এখন দিনহীন মানুষকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, যে কেউ খাবার নিতে পারে।
Leave a Reply